সাংবাদিকতা ক্ষমতাকেন্দ্রের মুখপাত্র নয়, জনগণের কণ্ঠস্বর

গত দুই দশকে বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিবর্তন হয়েছে। প্রিন্ট পত্রিকা এবং টেলিভিশনের চেয়ে বেশি মনোযোগ এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দিকে। অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ইউটিউব এমনকি টিকটকও তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই পরিবর্তন সাংবাদিকতার মান এবং গণমাধ্যমের ওপর জনসাধারণের আস্থাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে? মুনতাসির মারাই: আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এ প্রশ্নটির উত্তর দিতে চাই। সব বড় বড় সংবাদমাধ্যমের মতো আল–জাজিরাকেও এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আল–জাজিরা আমাদের প্রজন্ম বা আগের প্রজন্মের কাছে একেবারে ভিন্ন কিছু উপস্থাপন করেছিল। একটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল হিসেবে এটি সব সীমা ভেঙে কর্তৃপক্ষ, একনায়ক ও শাসকদের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল এবং প্রথমবারের মতো বিরোধী কণ্ঠস্বরকে সামনে এনেছিল। আরব বিশ্বে আমরা প্রথমবার নিজেদের দেশে বিরোধীদের কথা শুনতে পেয়েছিলাম, যা স্থানীয় কোনো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের অনুমতি ছিল না। আল–জাজিরার মাধ্যমে তারা সে সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু এখন ডিজিটাল যুগে এসে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা (আল–জাজিরা) জানি না ভবিষ্যতে নিজেদের অবস্থান কীভাবে নির্ধারণ করব। এটা কেন? কারণ, ডিজিটাল পরিসর অত্যন্ত খণ্ডিত। আগে পুরো আরব অঞ্চলের দর্শকেরা একসঙ্গে প্রাইম টাইমে একটি টিভি চ্যানেলে খবর শুনতে বসতেন। উদাহরণস্বরূপ, তখন আমরা ফিলিস্তিনকে প্রধান শিরোনাম করতে পারতাম, আর সবাই একসঙ্গে একই—অনুষ্ঠান দেখতেন। কিন্তু এখন দর্শক/পাঠক খণ্ডিত। প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা বেড়েছে আর মানুষ স্থানীয় প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছেন। স্থানীয় রেডিও, অনলাইন রেডিও, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, পডকাস্ট—সবই প্রসারিত হচ্ছে। ফলে আমরা কীভাবে এই বিচ্ছিন্ন দর্শকদের সঙ্গে কথা বলব, কীভাবে অগ্রাধিকার ঠিক করব, কীভাবে ভবিষ্যতে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করব—সেটিই বড় চ্যালেঞ্জ। তরুণ প্রজন্মের যাঁরা, তাঁরা এক ডিভাইস থেকে অন্য ডিভাইসে, এক প্ল্যাটফর্ম থেকে আরেক প্ল্যাটফর্মে লাফিয়ে বেড়ায়—আজ ফেসবুকে, কাল টিকটকে। ক্রমাগত ডিজিটাল অভিবাসন ঘটছে। আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে এই দর্শকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলব। প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। কারণ, এখন আর স্যাটেলাইট টিভি চালু করতে লাখ লাখ টাকা লাগে না। ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে কেউ ছাদে বসে নিজের ডিজিটাল নিউজ প্ল্যাটফর্ম চালু করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যা হচ্ছে, সেটির সবকিছুকেই কি সাংবাদিকতা বলা যায়? এখন তো দর্শকদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে অনেক বড় মূল্যবোধ বিসর্জন দিতে হচ্ছে; সংক্ষিপ্ত এবং দ্রুত করার চেষ্টা বা ঘটনার গভীরে যাওয়ার সময় নেই। মূল প্রশ্ন, ‘সাংবাদিকতা কি জনস্বার্থে কাজ করছে?’ অনেকেই সেটি বিবেচনা করছেন না। ফলে অনেক সময়েই কেউ কেউ ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। সাংবাদিক না হয়ে তাঁরা ইনফ্লুয়েন্সার হয়ে যাচ্ছেন।
শেয়ার করুন: